রাসূল (সাঃ) এর ২৪ ঘণ্টা থেকে আমাদের শিক্ষা
রাসূল (সাঃ) এর ২৪ ঘণ্টা থেকে আমাদের শিক্ষা
প্রায় সবাই জানি,মানুষ পরমাণু দিয়েই গঠিত কিন্তু মানুষের ভিতর যে 'মানস' থাকে তা কী দিয়ে তৈরি?
এর একক কী বলতে পারেন?
মানস,মন বা আত্মা যাই বলুন এর একক কেবল উত্তম চরিত্র যা গড়ে ওঠে প্রকৃষ্ট কিছু অভ্যাসের মাধ্যমে যাদের বলা হয় Atomic Habits।চরিত্র গুণেই মানুষ গুণান্বিত হয়।কেবল উত্তম আদর্শ তথা চরিত্রই মানুষকে সরেস,সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ করে তুলে।
অন্যের জীবনী পড়লে একটি জীবনকে জানা যায় আর সে জীবন থেকে প্রাপ্ত সকল শিক্ষাকে আপনি নিজ জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন।তাহলে আপনি কার জীবনী পড়ে নিজ জীবনে প্রয়োগ করবেন?
নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী কাউকেই।মাইকেল এইস হার্ট এর 'The Hundred' বইতে সেরা ১০০ মনীষীর তালিকায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কেই সর্বপ্রথমে রেখেছেন।তাছাড়া পবিত্র কোরআনে সূরা আহযাবে আল্লাহ বলেন-
لَقَدْ كَا نَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَا نَ يَرْجُوا اللّٰهَ وَا لْيَوْمَ الْاٰخِرَ وَذَكَرَ اللّٰهَ كَثِيْرًا ۗ
"তোমাদের জন্য আল্লাহর রসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।"
(৩৩:২১)
এবার নিশ্চয় আপনার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কীভাবে মুহাম্মদ (সাঃ) তার নিত্যদিনের ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত করতেন যা তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বানালো?
এটাই আলোচ্য বিষয়,চলুন শুরু করি,
রাসূল সাঃ এর নিত্যদিনের সকল কর্মকাণ্ডকে মূলত তিনভাগে ভাগ করা যায়-
▪ আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয়
▪ সামাজিক এবং
▪ ব্যাক্তিগত
আমাদের ক্ষেত্রে যা হয়,আমরা জীবনের যাত্রার সাথে ধর্মের মাত্রা এক রাখতে পারিনা,গুলিয়ে ফেলি বা ব্যর্থ হই কিন্তু রাসূল (সাঃ) এমনভাবে নিজের জীবন,সময় ও পারিপার্শ্বিক কাজকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আবর্তে বেধেছিলেন যা তার সাফল্যের অন্যতম সূত্র কারণ আধ্যাত্মিকতাই একমাত্র জিনিস যা আপনাকে এককভাবে শান্তিপূর্ণ জীবন দিতে পারে,ধর্মের বিমল শক্তি কোনভাবেই অস্বীকার করার নয়!
সাতটি ধাপে আমরা রাসূল (সাঃ) এর ২৪ ঘণ্টার নাতিদীর্ঘ আলোচনা করবো এবং নিজ জীবনে প্রয়োগের জন্য কিছু পরামর্শ দিবো।
✴ ফজর থেকে সূর্যোদয়
তাহাজ্জুদ শেষ করে রাসূল (সাঃ) শেষরাতেই ঘুমাতেন অতঃপর বিলালের আজানের ডাকে সাথে সাথেই উঠতেন,মিসওয়াক করতেন,দোয়া পড়তেন এবং ফজরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেন।তারপর ইকামত দিলে সাহাবিদের নিয়ে ফজরের ফরয নামাজ আদায় করতেন,ধর্মীয় আলোচনা করতেন এবং সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদেই অবস্থান করতেন।
✴ সূর্যোদয়ের পর থেকে যোহর
দুই রাকাত ইশরাকের নামাজ পড়ে রাসূল (সাঃ) ঘরে ফিরে আসতেন।মিসওয়াক করে পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিতেন,বাক্যালাপ করতেন।অধিকাংশ সময় রোজা রাখতেন,না রাখলে প্রাতরাশ হিসেবে খেজুর,উটের দুধ,রুটি এসব খেতেন।তিনিই যেহেতু মুসলমানদের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন,অনেক দায়িত্বভার নিয়ে তিনি সকল সামাজিক,রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতেন,সাহাবিদের সাথে মসজিদে আলোচনা করতেন,কুশলাদি বিনিময় করতেন।এরপর মধ্যাহ্নভোজ শেষে যোহরের আগ পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নিতেন নিতেন।
✴ যোহর থেকে আসর
বিলালের আজানে রাসূল (সাঃ) জেগে উঠতেন তারপর অজু করে সুন্নাত আদায় এবং তারপর মসজিদে গিয়ে ফরজ আদায় করতেন।এরপর তিনি সবাইকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন এবং সাহাবিদের নিয়ে দরকারী কাজ সেরে নিতেন,মাঝেমাঝে বাইরে যেতেন তা-নাহলে আসর পর্যন্ত মসজিদেই অবস্থান করতেন।
✴ আসর থেকে মাগরিব
এই সংক্ষিপ্ত সময়ে রাসূল (সাঃ) আসরের নামাজ আদায় করতেন অতঃপর মুসল্লীদের সাথে হালকা কথাবার্তা শেষে তিনি এই সময়টা নিতান্ত পারিবারিক রাখতেন,স্ত্রীদের সাথে দেখা করতেন এবং রাত্রীযাপন করতেন,তাদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন এবং দীন চর্চায় আগ্রহ জাগাতেন।
✴ মাগরিব থেকে এশা
মসজিদ থেকে মাগরিবের নামাজ শেষ করে রাসূল (সাঃ) ঘরে ফিরে এসে স্ত্রী'র সাথে,কখনোও বা সাহাবিদের সাথে সান্ধ্যভোজন বা সেরে নিতেন।ভোজ শেষে কিছুক্ষণ বাকবিনিময় তারপর শুকরিয়া আদায় করতেন।
✴ এশা থেকে মধ্যরাত
জামায়াতে নামাজ শেষ করে রাসূল (সাঃ) মসজিদ থেকে ফিরে এসে স্ত্রীদের সাথে অল্পক্ষণ পারিবারিক আলোচনা করতেন,মাঝেমাঝে নিকট সাহাবীদের বাসায় যেতেন এবং অন্যদের তিলাওয়াত শুনতেন।অতঃপর ঘরে ফিরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেন এবং স্ত্রীর সাথে রাত্রীযাপন করতেন।
✴ মধ্যরাত থেকে ফজর
অর্ধরাত্রিতে রাসূল (সাঃ) জেগে উঠে মিসওয়াক করতেন,অজু করে আকাশের দিকে তাকাতেন,সূরা আল ইমরানের শেষ দশ আয়াত পড়তেন এবং অনেক লম্বা সময় ধরে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন।এরপর বিতির আদায় করে কবর জিয়ারত করতেন তারপর ঘরে ফিরে ফজরের আগ পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিতেন।
এখন স্বল্প এই আলোচনার প্রেক্ষিতে এই রুটিন ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করার কিছু পরামর্শ দিবো।যদিও রাসূল (সাঃ) এর ব্যক্তিগত কোন রুটিন ছিলোনা,উপরোক্ত বর্ণনা বিভিন্ন হাদিস থেকেই নেওয়া।রাসূল (সাঃ) তার সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন এবং ধর্ম ও জীবনের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন।
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সাথে নিজের রুটিন খাপখাইয়ে নিন,ধর্মকে কেন্দ্র করে জীবন পরিচালনা করুন।
২.রাসূল (সাঃ) এর একাধিক স্ত্রী-সন্তান ছিলো মানে তিনি একজন স্বামী ছিলেন,বাবা ছিলেন,মসজিদের ইমাম,এছাড়াও সমাজপ্রধান,রাষ্ট্রনায়ক,আবার সেনাধ্যক্ষও ছিলেন,আর যা না বললেই নয় তিনি ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল।লক্ষ্য করুন তিনি এতসব দায়িত্ব কীভাবে সামলাতেন যেখানে অধিকাংশ সময় ইবাদতে কাটাতেন?
এক্ষেত্রে যা বলা যায়-
নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং দায়ভার গ্রহণ করুন।সততা,ভালোবাসা,
সহানুভূতি,নিষ্ঠা,ঐক্য ও ঈমানের সাথে জীবন গড়ুন দেখবেন আপনার অজান্তেই আপনার কাজগুলো সুশৃঙ্খল সুচারুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।
৩.জীবন তখনই প্রতিযোগিতাময় যখন আপনিও পারিপার্শ্বিক ছোয়ায় প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন।ইসলামী জীবনপদ্ধতি অতি উচ্চ বিলাসবহুল নয় খুব সাধাসিধা যা রাসূল (সাঃ) এর সুন্নত থেকেই বুঝা যায়।অথচ আমরা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের যাত্রী এবং নিজেদের যুক্তিতর্কে নিজেরাই বিপথে যাচ্ছি,অথচ আমরা চাইলেই Minimalistic Living এর এই শিক্ষা কাজে লাগাতে পারি।
৪.নিজের পরিবার এবং সমাজকে পর্যাপ্ত সময় দিন এতে আপনার ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা,পীড়ন দূর হয়ে যাবে।এখানেও আমরা উল্টো পথেই আছি,বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত বিকাশে স্বার্থপর ও বিচ্ছিন্ন হওয়া যেন একটা জেনেটিক রীতি হয়ে গেছে যেখানে 'আমি' অনেক শক্ত রুপে বিরাজ করে ফলে সমাজ,দেশ কিংবা জাতি কোথাও শান্তি নেই।আপনি বলতে পারেন,ধর্ম কাছে তাও শান্তি নেই কেন?
নিজেই ভাবুন একটু তুলনা করে,রাসূল সাঃ এর সমাজব্যবস্থা আর বর্তমানব্যবস্থা।এখন অবশ্য এটা বলতে কেউ দ্বিধাও করবেননা সেই যুগ অজ্ঞ ছিলো এখন তো ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল মুসলিম!মনে রাখুন,ধর্ম তখনই শান্তি দেয় যখন ধর্ম মানুষের চর্মে না বরং মানস ভেদ করে চারু ছড়ায়।
৫.সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করুন,আর কোন পাপ ভুলেও হবেনা আর যেদিন সত্যিকার ভাবে এটা পারবেন সেদিন আপনিও একজন Productive Muslim হতে পারবেন।মুসলমানরা পিছিয়ে যাচ্ছে কেন জানেন?
কারণ তারা না বুঝেই ধর্মচর্চা করে।না বুঝে কোরআন তিলাওয়াত,সিরাত পাঠ,হাদিস অধ্যয়ন!
যে সত্য আপনি বুকে ধারণ করেননা সেই সত্যের নেকিলোভী চর্চায় মেকী।বুঝে ধর্ম চর্চার মাঝে যে শান্তি তা আর কোথাও নেই।আমি আশাবাদী আপনারা রাসূলের নিত্যদিনের আলোকে নিজেদের আলোকিত করবেন
তথ্যসূত্রঃ
https://productivemuslim.com
আবদুল্লাহ আল ওয়াহাব এর মূল বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ "A Day in The Life of Muhammad"
লেখকঃমাঈন উদ্দিন
তরুণ কবি,বিজ্ঞান লেখক,পরিচালক-বি.এ.এস,আর,আই
মাসাআল্লাহ
ReplyDelete