সময়ের আপেক্ষিকতাঃবিশেষ অপেক্ষবাদের ভেল্কিবাজি!
সময়ের আপেক্ষিকতাঃবিশেষ অপেক্ষবাদের ভেল্কিবাজি!
আপেক্ষিকতা আধুনিক পদার্থবিদ্যার ঢাউস একটা বিষয়। শুধু এ নিয়েই আলবার্ট আইনস্টাইন সাহেবের আছে দু-দুটি থিওরি। বিশেষ আপেক্ষিকতা আর সাধারণ আপেক্ষিকতা নামে আমরা সেগুলোকে চিনি। বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি আইনস্টাইন সাহেব প্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে। তখন বিজ্ঞান মহলে দারুণ হইচই পড়ে। এর ১০ বছর পরে প্রকাশ করেন বিশেষ আপেক্ষিকতা। তত্ত্বের হিসাবের সাথে প্রমাণ মিলে যাওয়ায় রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে যান তিনি। পদার্থবিদ্যার দুটি মূল খুঁটির মধ্যে আপেক্ষিকতা একটি।
আরেকটি কোয়ান্টাম ফিজিক্স, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যার জন্ম দেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। পদার্থবিদ্যার যাবতীয় ভূতুড়ে ঘটনা ঘটে এই শাখায়, যা আমাদের বাস্তবিক জীবনের ঘটনাগুলি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের চিরাচরিত ধারণা ভেঙে পড়ে অণু-পরমাণুর এই ক্ষুদ্র জগতে।
যাই হোক, বিশেষ আপেক্ষিকতাও কিন্তু কম অদ্ভুত নয়। কারণ এখানে আছে আলোর অপরিবর্তনীয় গতি, সময় সম্প্রসারণ, দৈর্ঘ্য সংকোচনের মতো বিষয়। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের এই সময় সম্প্রসারণ এবং আলোর গতি নিয়েই এই আলোচনা। সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো।
আলোর গতি কি ধ্রুব? আলোর গতিতে গেলে কি সময় স্থির হয়ে যায়? সময় কি ধ্রুব নাকি আপেক্ষিক? আলোর গতিতে কি চলা সম্ভব? - এইসব অনেক প্রশ্ন নিয়ে অনেকেই আমরা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগি। এই আলোচনায় আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো।
আলোর গতি কি ধ্রুব:
(১) স্থান-কালের মধ্য দিয়ে শূন্য মাধ্যমে আলোর গতি সর্বদা ধ্রুব।
(২) মহাবিশ্বের সকল স্থানে পদার্থবিদ্যার সকল সূত্রই এক।
এই দুটি স্বীকার্য নিয়েই বিশেষ আপেক্ষিকতা গঠিত। কি, একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে? কালজয়ী তত্ত্ব, অথচ এতো সরল। দেখা যাক, কতোটা সরল!
প্রথমেই বুঝে নিতে হবে শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ আপেক্ষিক নয়, ধ্রুব। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করি।
একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করিঃ
ধরুন, আপনি আর আপনার বন্ধু একটি রাস্তায় একই দিকে দৌড়াচ্ছেন। আপনি আগে আর আপনার বন্ধু পিছনে। আপনার গতি ঘন্টায় ৩৫ কিমি আর আপনার বন্ধুর গতি ঘন্টায় ২৫ কিমি। তাহলে আপনার কাছে মনে হবে যে সে ঘন্টায় ( ৩৫-২৫ ) বা, ১০ কিমি বেগে দৌড়াচ্ছে। এখন আপনি পিছনে উল্টা দিকে ঘুরে গিয়ে আপনার বন্ধুর দিকে দৌড়াতে থাকলে আপনার মনে হবে যে আপনার বন্ধু আপনার দিকে ঘন্টায় ( ৩৫+২৫ ) বা, ৬০ কিমি বেগে ধেয়ে আসছে। আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। দেখা যাচ্ছে যে, কারো গতিই ধ্রুব থাকছে না, আপেক্ষিক হয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষকের ভিন্ন ভিন্ন প্রসংগ কাঠাময় কাছে ভিন্ন ভিন্ন রকম গতি মনে হবে। অর্থাৎ যখন আপনি পিছনে ঘুরে দৌড়াচ্ছেন তখন আপনার কাছে মনে হবে যে সে ঘন্টায় ৬০ কিমি বেগে আপনার দিকে আসছে। কিন্তু তার কাছে মনে হবে যে সে ঠিক ঘন্টায় ২৫ কিমি বেগেই দৌড়াচ্ছে। কাজেই আমরা বলতে পারি, একেকজনের কাছে বেগ একেকরকম মনে হয়।
এবার ধরা যাক, আপনি আলোর গতির অর্ধেক বেগে একটা স্পেসক্রাফটে করে যাচ্ছেন ( বলে রাখি, আলোর গতি শূন্য মাধ্যমে সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিমি )। আপনার পিছনের আরেকটি স্পেসক্রাফট থেকে কেউ একজন আপনার দিকে লেজার লাইট তাক করে আলো ছুড়ে দিল। তাহলে কি আপনার কাছে মনে হবে যে আলো আপনার দিকে আগের নিয়ম মেনে সেকেন্ডে ( ৩০০০০০-১৫০০০০ ) কিমি বেগে আসছে? মোটেই না। আবার আপনি যদি স্পেসক্রাফটটি পিছনে ঘুরিয়ে লেজার লাইটের দিকে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে কি আপনার কাছে মনে হবে যে আলো আপনার দিকে সেকেন্ডে ( ৩০০০০০+১৫০০০০ ) বা, ৪৫০০০০ কিমি বেগে আসছে? এবারো না। কারণ শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ ধ্রুব। এই গতি কারো সাপেক্ষে কখনো পরিবর্তন হবে না। উভয়ক্ষেত্রেই আপনি আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিমি দেখবেন! এটাই আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রথম স্বীকার্য। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? চাইলে স্পেসক্রাফটে আপনার স্পিডোমিটার দিয়ে যখন গতি মাপবেন, তখন এরকম ফলাফলই পাবেন। যাই হোক, দ্বিতীয় স্বীকার্য হচ্ছে যে আপনি কোনো এক্সপেরিমেন্ট এই মহাবিশ্বের যেখানেই করুম না কেন, ফলাফল সর্বদা একই আসবে। অর্থাৎ পদার্থবিদ্যার সকল সূত্র মহাবিশ্বের সকল স্থানেই একক থাকবে জায়গায়ই এক থাকবে। পৃথিবীতে গ্রাভিটি যে নিয়ম মানে, নেপচুনেও একই নিয়ম মানে।
আমাদের মূল আলোচনা আলো আর সময় নিয়ে, তাই আপাতত ২য় স্বীকার্যটি নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছি।
সময়ের সম্প্রসারণ!
বিশেষ আপেক্ষিকতার মজার আর অদ্ভুত একটি দিক হলো সময়ের সম্প্রসারণ। ব্যাপারটা কেমন? এটা বোঝার জন্য আরো একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।
এজন্য দরকার হবে দুটি অসাধারণ লাইট ক্লিক ক্লকের। কিন্তু আগে ঘড়ি কিভাবে কাজ করে তা জানা জানা দরকার। সাধারণত আমরা যে ডিজিটাল ঘড়ি ব্যবহার করি তা দিয়ে সময় নির্ধারণ করা হয় কোয়ার্টজ ক্রিস্টালের কম্পন ব্যবহার করে। কোয়ার্টজ ক্রিস্টালগুলো সেকেন্ডে ৩২,৭৬৮ বার কম্পিত হয়। ঘড়িতে থাকা ইলেক্ট্রনিক সার্কিট এগুলো ক্যালকুলেট করে ১ সেকেন্ড নির্ধারণ করে।
আমাদের এক্সপেরিমেন্টের ঘড়ি দুটি হবে আলো দিয়ে তৈরি ( অবশ্যি কল্পনায় )। নাম হবে লাইট ক্লিক ক্লক। এজন্য আমাদের দরকার হবে আলোর একটি পালস যা দুটি আয়নার মধ্যে বাউন্স করতে থাকবে। আয়না দুটির মধ্যে দুরত্ব হবে আলো ১ সেকেন্ডে যে দুরত্ব অতিক্রম করে, তার অর্ধেক। অর্থাৎ ১ম আয়না থেকে ২য় আয়নার দুরত্ব হবে ( ৩০০০০০০÷২ ) বা, ১৫০০০০ কিমি। কাজেই ১ম আয়না থেকে আলো ২য় আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আবার ১ম আয়নায় আসতে সময় লাগবে (০.৫+০.৫ ) বা, ১ সেকেন্ড ( যেহেতু ১ম আয়না থেকে ২য় আয়নার দুরত্ব ১৫০০০০ কিমি, সেহেতু সময়ও লাগবে ( ১÷২) বা ০.৫ সেকেন্ড )। এরকম দুটি ঘড়ি তৈরি করা হলো।
এবার আপনি আলোর অর্ধেক গতিসম্পন্ন একটা স্পেসক্রাফটে চড়ে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে একটা মিশনে রওনা দিলেন। তার আগে ঘড়ি দুটো পরীক্ষা করে নিলেন। দেখলেন যে ঘড়ি দুটি একই সময়েই পালস দিচ্ছে। এবার আপনি স্পেসক্রাফটে একটা ঘড়ি নিয়ে মহাজাগতিক যাত্রা শুরু করলেন। আর আপনার একজন বন্ধু পৃথিবীতে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল। ধরা যাক, স্পেসক্রাফটের ক্যামেরা দিয়ে আপনাকে আপনার বন্ধু দেখতে পাচ্ছে।
স্পেসক্রাফট যেহেতু আলোর অর্ধেক গতিতে যাচ্ছে ( সেকেন্ডে ১৫০০০০ কিমি গতি ), কাজেই আমরা বলতে পারি যে -
১ সেকেন্ডে স্পেসক্রাফটটি যায় ১৫০০০০ কিমি
সুতরাং ০.৫ সেকেন্ডে যায় ( ১৫০০০০×০.৫ ) কিমি
= ৭৫০০০ কিমি
অর্ধসেকেন্ডে আলোর পালসটি উপরে ১৫০০০০ কিমি উঠতে পারে। আবার অর্ধসেকেন্ডে স্পেসক্রাফটটি ৭৫০০০ কিমি দুরত্ব অতিক্রম করে। পৃথিবীতে অবস্থানরত আপনার বন্ধু দেখবে যে তার নিজের ঘড়িটিতে আলোর পালস স্বাভাবিকভাবেই উপর নিচে সোজা-সরলরেখায় উঠছে আর নামছে। কিন্তু আপনি যেহেতু স্পেসক্রাফটে চলমান, তাই আপনার বন্ধু দেখবে আলোর পালসটি সোজাসুজি উপরে না উঠে একটি বেঁকে যাচ্ছে ( চিত্রে দেখুন )। ফলে আলোর পালস একটি ত্রিভুজ আকৃতি ধারণ করে। এই বেঁকে যাওয়া পরিমাণ ( অতিভুজ ) আমার গুরু পিথাগোরাসের সেই বিখ্যাত উপপাদ্য থেকেই বের করা যায় -
অতিভুজ^২ = লম্ব^২+ভূমি^২
বা, অতিভুজ^২ = ১৫০০০০^২+৭৫০০০^২
বা, অতিভুজ^২ = ২২,৫০০,০০০,০০০+৫,৬২৫,০০০,০০০
বা, অতিভুজ = ✔২৮,১২৫,০০০,০০০
•°• অতিভুজ = ১,৬৭,৭০৫
অতএব বেঁকে গিয়ে আলোর পালস অর্ধসেকেন্ডে ১,৫০,০০০ কিমির জায়গায় ১,৬৭,৭০৫ কিমি অতিক্রম করছে। অর্থাৎ ১৭,৭০৫ কিমি বেশি অতিক্রম করছে। দাঁড়ান, দাঁড়ান......! তাহলে পালসটি ১ সেকেন্ডে অতিক্রম করবে ( ১৬৭৭০৫+১৬৭৭০৫ ) কিমি
= ৩,৩৫,৪১০ কিমি!
কিন্তু একটু আগেই তো আমরা পড়ে আসলাম যে আলোর বেগ ধ্রুব। এর কোনো পরিবর্তন হয় না। কিছু কি একটা সমস্যা হয়েছে? হ্যাঁ, প্রকৃতি এখানে সমস্যা বাঁধিয়ে দিয়েছে। ভয় নেই, প্রকৃতিই এটার সমাধান করে দেবে!
এখানে যেহেতু আলোর বেগ ধ্রুব , সেহেতু আমাদের অন্যান্য রাশিগুলো পরিবর্তন করে দিতে হবে। ব্যাপারটা কিরকম?
ধরি, খসরু তার এন্ড্রোমিডা স্পেসক্রাফটে করে ইটা ক্যারিনা গ্যালাক্সির দিকে রওনা দিল। সে স্পেসক্রাফটে করে ১ সেকেন্ডে ৭৫০০০ মিটার যেতে পারে। ২ সেকেন্ডে যেতে পারে ১৫০০০০ মিটার। ৩ সেকেন্ডে যেতে পারে ২২৫০০০ মিটার। তাহলে আমরা লিখতে পারি -
দুরত্ব🔀সময়
বা, দুরত্ব = ক× সময়
বা, ক = দুরত্ব÷সময়
বা, ক = ২২৫০০০÷৩
•°• ক = ৭৫০০০
এই 'ক' ই হলো উপরের সমীকরণের সমানুপাতিক ধ্রুবকের মান। সমানুপাতিক ধ্রুবক নিউটন দাদুর সূত্রে আমরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকি ( G ). দেখুন উপরের সমীকরণের ক কিংবা মহাকর্ষ সূত্রের G - এর মান কিন্তু সর্বদা ধ্রুব থাকে। বদলায় না। তাই সমীকরণে 'ক' এর মান ঠিক রাখতে অন্য দুটি রাশি সময় এবং দুরত্ব বদলাতে হচ্ছে। এখানে রাশি দুইটির মান
দুরত্ব - ৭৫০০০ ,১৫০০০০,২২৫০০০ মিটার আর সময় - ১,২,৩ সেকেন্ড। দেখুন আয়ের সাথে সময়ও বদলে যাচ্ছে 'ক' এর মান ঠিক রাখার জন্য। আলোর বেগের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
আলোর বেগ = দুরত্ব ( দৈর্ঘ্য) ÷সময়
এখানে যেহেতু আলোর বেগ ধ্রুব, তাই একে ধ্রুব রাখতে দুরত্ব ও সময় এক্ষেত্রে বদলে যাবে।
আলোর বেগকে ধ্রুব রাখতে আপনার বন্ধু পৃথিবী থেকে দেখবে যে স্পেসক্রাফটে আপনার সময় ধীরে চলছে।
কিন্তু কেন? কারণ প্রকৃতি এটা ঠিক করে রেখেছে যে আলোর গতিই হবে স্থান-কালের মধ্য দিয়ে ইউনিভার্সাল স্পিড লিমিট এর বাইরে যাওয়ার নিয়ম নাই। তাই, আলোর বেগকে যদি আমরা ধ্রুব রাখতে চাই তাহলে সময়কে পরিবর্তন করতেই হবে। অর্থাৎ আপনার বন্ধুর সাপেক্ষে আপনার সময় স্লো হয়ে যাবে। সেই পরিমাণটা হবে কতো? আমরা দেখেছি যে আপনার স্থির বন্ধুর ঘড়ির পালস এক সেকেন্ডে ঠিক ৩০০০০০ কিমি অতিক্রম করে। কিন্তু আপনারটা করছে ৩৩৫৪১০ কিমি। তাই আমরা লিখতে পারি -
আলো,
৩০০০০০ কিমি যায় ১ সেকেন্ডে
•°• ৩৩৫৪১০ ,, ,, ( ৩৩৫৪১০÷৩০০০০০ ),,
= ১.১১৮০৩৩৩৩৩ সেকেন্ডে
অর্থাৎ আপনার কাছে যখন মনে হবে ১ সেকেন্ড, আপনার বন্ধুর কাছে মনে ১.১১৮০৩৩৩৩৩ সেকেন্ড। কারণ আপনি স্পেসক্রাফটের মধ্য থেকে কিছুই বুঝতে পারবেন না। আপনার কাছে মনে হবে যে আপনার আলোর পালসটি সরলরেখায়ই বাউন্স করছে, সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হবে। আপনার বন্ধুর কাছে মনে হবে যে আপনার কাছে সময় স্লো হয়ে গিয়েছে। এটাই আইনস্টাইন সাহেবের বিশেষ আপেক্ষিকতার টাইম ডাইলেশন বা সময় সম্প্রসারণের নীতি! গতির ভিন্নতার কারণে স্থির ও গতিশীল কাঠামো থেকে সময় পরিবর্তন হয়ে যায়। স্থির বস্তুর কাছে সময় অতিবাহিত হয় দ্রুতভাবে। কিন্তু গতিশীল বস্তুর কাছে সময় ধীর হয়ে যায়। অর্থাৎ সময় আপেক্ষিক বিষয়। ধ্রুব নয়।
এবার আসি আপেক্ষিকতার যেসব ব্যাপার নিয়ে আমরা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগি সেসব প্রশ্নে।
আমার আর ছামছু ভাইয়ের কথোপকথন!
ছামছুঃ আচ্ছা, আমরা কি আলোর গতিতে চলতে পারবো?
আমিঃ হ্যাঁ, পারবেন। কিন্তু সেজন্য আপনাকে ভরশূন্য হতে হবে। পারবেন? আলোর কিন্তু কোনো ভর নেই।
ছামছুঃ ইয়ে মানে.........তা তো সম্ভব না। অন্য কোনো সিস্টিম নাই?
আমিঃ দাঁড়ান, ভরবৃদ্ধির কিংবা সময় সম্প্রসারণের সমীকরণে ডাইরেক্ট অ্যাকশানে গিয়ে দেখি, আপনার সমস্যার কোনো কূলকিনারা করা যায় কিনা! বিশেষ আপেক্ষিকতার ভরবৃদ্ধির সূত্রটি এরকম -
m = m°÷ ✔1- v^2÷c^2
এখানে m = ভর, c= আলোর বেগ ও v= গতি.
তাহলে ভরযুক্ত বস্তুর গতি v= ৩০০০০০ কিমি ( আলোর বেগ ) ধরি, তাহলে আমরা লিখতে পারি -
m = m°÷ ✔১ - ৩০০০০০^২÷৩০০০০০^২
বা, m = m° ÷ ✔১ - ৯০০০০০০০০০০÷৯০০০০০০০০০০
বা, m = m° ÷ ✔১-১
বা, m = m° ÷ ✔০
বা, m = m° ÷ ০
•°• m = অসংজ্ঞায়িত
আবার সময় সম্প্রসারণের সূত্রটিও একইরকম -
t = m° ÷ ✔1- v^2÷c^2
এই সূত্রে যদি আপনি v = আলোর গতি বা ৩০০০০০ কিমি বসান, তাহলেও একই ফল পাবেন।
তাই, দেখতেই পাচ্ছেন যে আলোর গতিতে চললে সমীকরণণে উল্টা-পালটা ফলাফল দেখা যাচ্ছে।
ছামছুঃ ওহ....এই ব্যাপার!
আমিঃ হুঁ!
ছামছুঃ আচ্ছা এতক্ষণ ধরে তো একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করলেন। কিন্তু আমার তো প্রমাণ চাই। টাইম ডাইলেশনের
কোনো প্রমাণ আছে কি?
আমিঃ টাইম ডাইলেশনের প্রমাণ অনেকগুলি আছে। এর মধ্যে একটা হলো মিউওন কণা আয়ু। মহাকাশের বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক থেকে যখন মহাজাগতিক রশ্মি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে আঘাত করে, তখন মিউওন নামক কণার উৎপত্তি হয়। এই কণার আয়ু হচ্ছে ২.২ মাইক্রোসেকেণ্ড! মিউওন আলোর প্রায় কাছাকাছি গতিতে চলে। এই গতিতে বড়োজোর ৬৬০ মিটার পথ অতিক্রম করতে পারে এই কণা। কিন্তু অতো উপরের বায়ুমণ্ডল থেকেও মিউওন দিব্বি ভূমিতে বসানো ডিটেক্টরে ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়ে গেল। ৬৬০ মিটার পথ অতিক্রম করার কথা মিউওনের, কিন্তু এতো পথ অতিক্রম করতে পারছে কেন? এখন বিশেষ আপেক্ষিকতার সময় সম্প্রসারণের সূত্র থেকে আমরা জানি, আলোর গতির ০.৯৯৯৪ গতিতে গেলে ২.২ মাইক্রোসেকেণ্ড থেকে সময় সম্প্রসারিত হয়ে এটি প্রায় ৩০ গুণ বেশি সময়, অর্থাৎ ৬৩.৫১ মাইক্রোসেকেণ্ডে পরিণত হয়। ফলে মিউওন প্রায় ৬৬০ মিটারের থেকে ১৯ কিমি পথ অতিক্রম করতে পারে। সময় সম্প্রসারণের সূত্রটি ভরবৃদ্ধির সূত্রের মতোই -
t = t° ÷ ✔1-v^2÷c^2
ছামছুঃ কি জিনিস আইনস্টাইন সাহেব আবিষ্কার করে গেছেন! অতীব সুন্দর বিষয়! আচ্ছা, E=mc^2 জিনিসটা কি? অনেকের কাছে শুনেছি এটা নাকি পদার্থবিদ্যার শ্রেষ্ঠ ইকুয়েশন!
আমিঃ হাহা....! এটা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সূত্র। এই সূত্রমতে ভর আর শক্তি আলাদা কিছু নয়। একে অপরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ মাত্র!
ছামছুঃ বলেন কি?
আমিঃ কথা সত্য। শক্তি হচ্ছে কোনো বস্তুর ভর আর আলোর বেগের বর্গের গুণফল! ভেবেছেন ১ গ্রাম ভরের বস্তু থেকেও কতো শক্তি পাওয়া যায়, যেহেতু আলোর বেগের বর্গ একটি বিশাল সংখ্যা! আবার ভর হচ্ছে আলোর বর্গকে শক্তি দিয়ে ভাগ করে পাওয়া রাশি! এই সূত্র ব্যবহার করেই কিন্তু নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করা হয়। এই বোমার বিস্ফোরণে ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই সিস্টেমকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশান। আর সূর্যের হালকা-হালকা মৌল মিলে ভারী মৌল তৈরি হওয়ার সময়ও ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। একে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশান! এই সমীকরণও বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে।
ছামছুঃ ওহ! আচ্ছা ভাই, আলোর গতিতে চলা নিয়ে তো আর কিছু বললেন না। আমাদের হাতে কি আর কোনো উপায় নাই?
আমিঃ উপায় আছে বৈকি । কিন্তু সেজন্য তো আপনার দৈর্ঘ্য শূন্য হতে হবে। অর্থাৎ আপনার অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।
ছামছুঃ কিন্তু এমনটা হবে কেন?
আমিঃ বিশেষ আপেক্ষিকতার দৈর্ঘ্য সংকোচনের সূত্রটি হলো-
L = L• ✔1 - v^2÷c^2
এখানে যদি V = ৩০০০০০ কিমি বসাই, তাহলে পাই -
L = L° ✔ ৩০০০০০^২÷ ৩০০০০^২
বা, L = L° ✔ ১ - ৯০০০০০০০০০০÷৯০০০০০০০০০০
বা, L = L° ✔ ১ - ১
বা, L = L° ✔০
বা, L = L°× ০
বা, L = ০
দেখতেই পাচ্ছেন যে, আলোর গতিতে চলতে হলে আপনার দৈর্ঘ্য ০ হতে হবে। অর্থাৎ আপনার অস্তিত্বই থাকতে পারবে না। দৈর্ঘ্য সংকোচনের মূল নীতি হলো কোনো বস্তুর বেগ যতো বাড়বে, স্থির কাঠামোর সাপেক্ষে তার দৈর্ঘ্যও ততো কমবে।
ছামছুঃ অ......তাহলে আমাদের পক্ষে আলোর গতিতে চলা অসম্ভব ( খানিকটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ) ?
আমিঃ আসলে সত্য কথা হলো গিয়ে........ কোনো ভরযুক্ত বস্তুই আইনস্টাইন সাহেবের আপেক্ষিক তত্ত্বানুসারে আলোর গতিতে যেতে পারবে না। আর এখনো এই তত্ত্বকে কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারে নি। একমাত্র ভরহীন বস্তুরাই আলোর গতিতে চলতে পারবে। আর আলোর গতিতে চললে সময় পুরোপুরি স্থির হয়ে যায়। আলোর কাছে সময়ের কোনো মূল্য নাই, সময়ই তার কাছে স্থির। আর আলোর কাছে পুরো মহাবিশ্ব সংকুচিত দেখায়।
আরেকটা বিষয় আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে শূন্য মাধ্যমে আলোর গতি ছাড়া সবকিছুই আপেক্ষিকভাবে এক-একরকম দেখায়। সময় স্লো হয়ে যায় না, স্লো দেখায়। আবার দৈর্ঘ্যও কমে যায় না, কমে যাচ্ছে এরকম দেখায়। আপনি আপনার চারপাশে যেসব দেখেন, সেটাই একমাত্র ধ্রুব সত্য নয়, আবার ভুলও নয়। স্থির কিংবা গতিশীল কাঠামোর সাপেক্ষে সবকিছুই এক-একরকম দেখায়। দুটো ফলাফলই তাদের নিজ নিজ কাঠামোর ক্ষেত্রে সত্যি!
শেষ কথা!
আলবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা থেকে সময় সম্প্রসারণ, ভরবৃদ্ধি, দৈর্ঘ্য সংকোচন, ভর-শক্তির সমীকরণের মতো চমকপ্রদ সব অদ্ভুত বিষয় উঠে এসেছে। শুধু সময় সম্প্রসারণ নিয়ে লিখবো বলে শুরু করে অন্যান্য বিষয়গুলি একেবারে এড়িয়ে যেতে পারিনি।
☺
তবে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব নামে খ্যাত আপেক্ষিকতার অন্য আরেকটি তত্ত্ব নিয়ে একেবারেই আলোচনা করতে পারিনি। এই তত্ত্বের প্রেক্ষাপটই সম্পূর্ণ ভিন্ন, প্রকৃতির একটি মৌলিক বল মহাকর্ষ নিয়ে। এই তত্ত্ব আবার পদার্থবিদ্যা ছাড়া কসমোলজিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়! সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে সময়কে আবার মাত্রা হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়েছে! সে আরেক কেচ্ছা! এসব নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো খন!
আলবার্ট সাহেব ছিলেন পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে লুব্ধকের মতোই একটি উজ্জ্বল তারা। এত্ত্বোসব বৈপ্লবিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে পদার্থবিদ্যাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনকে বলা হয় সর্বকালের সর্বসেরা পদার্থবিদ!
No comments